Skip to main content

জাহাজ হস্তশিল্পের শেষ রিয়াসৎ

আনুমানিক ৪০০ বছর আগে ধনী ব্যাপারীরা গ্রীষ্ম বসন্ত কালে এক উঁচু মিনারের চূড়ায় দাঁড়িয়ে তাদের জাহাজের উপর বাজি রাখতেন যে কার জাহাজ আগে বন্দরে পৌঁছবে। সেই মিনারটি জাহাজের বাজি ধরার জন্য ব্যবহার হতো বলে তার নাম  'tower of wager' হয়ে গেল। মূলতঃ আফ্রিকার পূর্ব উপকূল এবং আরব যাওয়া-আসার সমস্ত জাহাজ এই বন্দরে নোঙ্গর ফেলতো। মান্ডভী, গুজরাতের এক উপকূল শহর। ষোড়শ শতাব্দীর প্রাচুর্যপূর্ণ সমৃদ্ধিশালী  বন্দর, যেখানে আজও হাতে মানে ছেনি-বাটালি দিয়ে কারিগড়রা জাহাজ তৈরি করেন যা আরব সাগরে পাড়ি দেয়। সারা পৃথিবীতে আর কোথাও এমন হাতে করে জাহাজ তৈরি হয়না।

আমার ভালো লাগার শহর গুলোর মধ্যে মান্ডভী অন্যতম। রুক্মাবতী নদীর তীরে এককালের প্রসিদ্ধ বন্দর তার জরাজীর্ণ সুবৃহৎ অট্টালিকা, মলিন হয়ে যাওয়া রঙ্গিন জানালার শার্সি, বট-অশথ্ব গাছের শেকড়ে আটকে পরা অতিথিশালা, জংলা রাস্তা নিয়ে আজ তাকিয়ে আছে নদীর  দিকে হটাৎ যদি সাদা মাস্তুলের কোনো আরব্য রজনীর ডিঙি ধেয়ে আসে, তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে হবে তো !




কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ভূজ থেকে মান্ডভী গিয়েছিলাম, নরেন্দ্র (আমার ড্রাইভার) ভাইয়ের কথা শুনে কিছুটা আগ্রহ হলো। যথারীতি আমার থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই, সুতরাং যাবার পথে গুগলে ঘেঁটে একটা গেস্ট হাউসের খোঁজ পেলাম, নাম রুক্মাবতী এবং সেটা মান্ডভীর দোড়গোড়েই, তাই খুঁজতে কোনো সমস্যাই হয় নি। জাতীয় সড়ক ৩৪১ ধরে ভুজ থেকে মান্ডভী আসার সময় পাথরের এক মাঝারি উচ্চতার প্রবেশদ্বার দেখলাম আর সেখান থেকেই  মান্ডভীর সীমানা শুরু হলো। এই গেট পেরোনোর পর এক ইয়াবড় অর্ধ নির্মিতি জাহাজ দেখলাম, সেটা নাকি হাতে তৈরি হচ্ছে, ছেনি-বাটালি আর পেরেক ঠুকে। কিছু জায়গা আছে যা প্রথমে দেখেই ভালো লেগে যায়, অবশ্য 'এই পছন্দের' পেছনে সেই জায়গার লোকজনের অমায়িক ব্যবহার অনেকটা দায়ী।  গেস্টহাউসের কেয়ারটেকার বিজয়ের সাথে ফাঁকা ঘর গুলো দেখার পর আমি টেরাসের একটা ঘর নিলাম, পাশেই দোলনা, প্রচুর গাছ, পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে খাবারের ব্যবস্থা নেই তবে চা করার ব্যবস্থা রয়েছে। স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম মান্ডভী চড়ে বেড়াতে। মোহাম্মদ ভাই, আমার মান্ডভীর ট্যুর  গাইড, ফটোগ্রাফার এবং অটো চালক। বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে তার অটোরিকশাতেই ঘুরে বেড়িয়েছি, সেসব আমার ব্লগ বিস্তারিত লিখেছি। Mandvi: the lost port 




পুরো শহর  টা প্রায় ১০ ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা যদি  ২০০১ সালে  ভুজের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে একদিকে ভেঙে গেছে। প্রচুর গ্রেটার ফ্লামিংগো, বিচ আর জাহাজের শহর। পুরোনো শহরের গন্ধ  আমার অতি পছন্দের জিনিস আর যেখানে এতো বড়ো ইতিহাস ঘাপটি মেরে বসে আসে তার সাথে তো বেশ কয়েক ঘন্টা কাটাতেই হবে। ১৪৯৭ সালে ভাস্কো দা গামা যখন Europe-to-India সমুদ্র পথ আবিষ্কার করে কালিকট বন্দরে আসলেন পরোক্ষ ভাবে তার সাথে মান্ডভীর যোগাযোগ হয় এক কুচি নাবিক কাঞ্জি মালানের দ্বারা। কাঞ্জি মালানের সাথে গামার পরিচয় কেনিয়ার মালিন্দী বন্দর থেকে এবং সেখান থেকে সোজা  কাঞ্জিই  নাকি গামাকে কালিকট আসার নৌপথ দেখিয়েছিলেন। কাঞ্জি মালান ছিলেন মান্ডভী শহরের এক ধনী ব্যাপারী।

১৫৮০ সালে কচ্ছের রাও প্রথম খেনগরজী  মান্ডভীর প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু নগরদুর্গটি তারও তিন দশেক আগে তৈরি হয়ে গেছে, মানে মান্ডভী বন্দর হিসেবে তার রাজত্ব শুরু করে দিয়েছিলো শহর পত্তনের অনেক আগেই। প্রায় ৪০০ বছর অগাধ ধন-সম্পত্তি -মর্যাদা আর গর্বের সাথে রাজ্যত্বের পর যখন ঊনবিংশ শেষের দিকে আরেক প্রিয় শহর মুম্বাই তার তৎকালীন 'বোম্বে' নামের বন্দর যখন আস্তে-আস্তে দাপট শুরু করছে মান্ডভী একটু-একটু করে হাল ছাড়তে শুরু করলো আর বছর দশেকের মধ্যে তার ঝুলি থেকে যাবতীয় সব গৌরব বোম্বাইকে দিয়ে ম্লান হয়ে গেলো।




আঠারোশো শতাব্দীতে মান্ডভীর স্হায়ী ব্যাপারীদের কাছে ৪০০ বেশি 'ট্রেডিং ভেসেল' ছিল যা পূর্ব আফ্রিকা, পার্সির উপসাগর মালবার উপকূলে চলতো। এই বন্দর বিশেষতঃ স্পাইস ট্রেড-রুট ' আর মরুভূমির উটে টানা গাড়ির  'ট্রেড-রুট' হিসেবে ব্যবহার হতো।  মান্ডভীর সামুদ্রিক লেনদেনের কারবার যখন তুঙ্গে তখন মাল আমদানি করার চেয়ে এই বন্দর-শহর টি গুণ বেশি মুনাফা দিয়েছে মাল  রপ্তানি করে। এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বন্দরের গৌরব গাঁথা, ইউরোপিয়ান-পর্তুগিজ ধাঁচে তৈরি বাড়ি, অতিথিশালা, courtyard, রাস্তা, সমুদ্রের পাশে বসার পানশালা, বাজার সব ভেঙ্গেচুরে আছে আছে আর কি!




এক জাহাজ তৈরির কারখানায় তথা প্রদর্শনাগারে গেলাম, Sagar Ship Model, তারা বংশ পরম্পরায় হাতে ডিঙিজাহাজ তৈরি করে আরবের দেশ গুলিতে রপ্তানি করে এখনো। নিদৃষ্ট সময় মেরামতের জন্য জাহাজ গুলো এখানেই আসে। ছোট-মাঝারি-বড়ো বিভিন্ন মাপের জাহাজ এবং বিবর্তনের ইতিবৃত্ত রয়েছে। তাদের সাথে কথা বলে অনেক কিছু জানলাম। আপনার পছন্দ মতো জাহাজ বানিয়ে দেবে মানে ধরুন Black pearl, Unicorn, Titanic বা Edinburg Trader বানিয়ে দেবে। আপনাকে শুধু তার সাইজ বলে দিতে হবে।  কারখানার উল্টো দিকেই প্রচুর পরিত্যাক্ত পুরোনো ধাঁচের অট্টালিকা বাড়ি রয়েছে, সেগুলো এককালে অতিথিশালা ছিল।




ভাবুন তো ভূমধ্যসাগরে, আরব সাগরে, এমন কি ভারত মহাসাগরেও বহাল তবিয়তে যে ডিঙ্গি, বিভিন্ন মাপের পাল তোলা জাহাজ ভেসে বেড়াচ্ছে সেগুলো এই ছোট্ট একখানি শহর মান্ডভীতে তৈরি হয়েছে তাও আবার কোনো বড়ো, আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া।




Related Link - Mandvi: the lost port

Comments

Popular posts from this blog

কদম ফুল - Kadam phool- common burflower

বর্ষাকালের সিগনেচার বলা হয় কদম ফুলকে , আরেক নাম নীপ , " এসো নীপ বনে ... " কবিতা তো জানাই আছে যাতে বর্ষা মানেই নীপ ( কদম্ব ও বলে অনেক রাজ্যে ) ।   খুব পরিচিত এই ফুল , নিটোল গোলাকার , প্রথমে সবুজ , পরে লাল থেকে টকটকে কমলা রঙের সাথে অসংখ্য লম্বা সাদা ফ্রিলস পুরো ফুল জুড়ে ।   হাতে নিলে বোঝা যায় বেশ একটু ভারী , মানে কাউকে ঢিল ছুড়ে মারার মতো আর ওই সাদা ফ্রিলস গুলো এমনিতে নরম কিন্তু ছুড়লে হুঁহুঁ , লাগবে বেশ। খুব মিষ্টি একটা গন্ধ আছে , গাছের পাস দিয়ে গেলেই টের পাওয়া যায় ফুল ফুটেছে   ( কদম তলায় কে ?) । প্রচুর ফ্র্যাংগনান্স বা আতর তৈরি হয় এই গন্ধের। আমাদের দেশের লিপিগুলোতে কদম ফুলের ও গাছের নাম আছে আর আমাদের পৌরাণিক কথকথায় কদম ফুলের বড়ো মুখ্য একটা জায়গা আছে।   ভারতের উত্তর দিকে , ভগবৎ পুরান থেকে শুরু রাধা ও কৃষ্ণের দুজনের জীবনেই   কদম ফুল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।   বৃন্দাবন - মথুরায় , গোবর্দ্ধন পাহাড়ের দিকে   প্রচুর কদম গাছ , এই সময় মানে বর্ষাকালে একবার রাধে - রাধে

রাগের ছবি

১ ) মেঘ মল্লার : মেঘ ( সংস্কৃত বুৎপত্তি ) মল্লার একটি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় মৌসুমী   রাগ।   কথায় বলে এই রাগ বৃষ্টিকে আমন্ত্রণ করে যেখানে গাওয়া হয় সেখানে। ' মেঘ মল্লার ' রাগ মেঘের অনুরূপ যার মধ্যে মল্লারের আভা রয়েছে। মল্লার পরিবারের অন্যান্ন রাগগুলি হলো : মেঘ , মিয়াঁ কি মল্লার , গৌড় মল্লার , রামদাসী মল্লার , ধুলিয়া মল্লার ইত্যাদি। ঠাট : কাফি। আমাজন প্রাইমের ' বন্দিশ ব্যান্ডিট ' ওয়েব সিরিজের লাস্ট এপিসোডে ফরিদ হাসান আর মোহাম্মদ আমান মেঘ মল্লার গেয়েছে এবং তাতে বৃষ্টি এসেছে। শঙ্কর - এহসান - লয় এই   গানের দ্বায়ীত্বে ছিলেন। একটা আর্টিকলে তাদের কথা পড়লাম যে , যোধপুরে ২০২০ - র এপ্রিল মাসে এই গানটা যেদিন পুরো গাওয়া হয়েছিল সত্যি বৃষ্টি পড়েছিল , যা কোনোদিনও হয় নি নাকি। ২ ) গৌড় মল্লার :   হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি রাগ যা মল্লারের বৈশিষ্ট্য বহন করে আর এই   ' গৌড় ' নামের রাগটি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে , মানে সে রকম করে কেউ গায় না । মল্লার পরিবারের

Baya Weaver's Nest

Once upon a time huge number of retort-shaped Babui’s nests were hanged from the coconut trees of my home. The small sparrow type gregarious bird commonly known as Baya Weaver but in Bengali we called them as “ Babui pakhi " . These birds are famous for the elaborately woven nests   hanging from tree's twig. The colour of  both male and female  birds is grey but during their breeding season the male becomes yellow in colour with a crown.  I spent some time in my childhood to explore the type and stage of the nest, the weaving process of the nest by the birds and now I realise those moments  were really worthy .  It was really an excellent experience to exploring the phase of the nest. Even I used to collect the abandoned, broken or old nest when those were dropped off to the ground.  The awesome nests mostly can be found in villages not in the cities, specially in India. Nowadays it's rare to see them due to lot of man made changes... recently I went to Bag