Skip to main content

মাই-বাব্বা

আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর-পূর্ব উপকূল বরাবর হাঁটছেন, হটাৎ কানে এলো ভোজপুরি গানের কলি...

একজন পুরুষ মানুষের দাম ২৫ টাকা আর একজন মহিলার দাম ৩৫ টাকা...

আমাদের সক্কলের পছন্দের জিনিস রয়েছে, আর সেটা হারিয়ে গেলে বড্ড কষ্ট হয়, আর সেখানে যদি তা কেউ জোর করে দূরে সরিয়ে দেয় ? আর ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবারই ভিটে-মাটি বড়ই সাধের জিনিস, সে যেমন ঘর হোক না কেন!  আর তার পাস দিয়ে বয়ে চলা নদী, সে তো সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে থাকে আজীবন। সেই পছন্দের জিনিস গুলো, ঘর-মাটি, নদী সব ছেড়ে মিছে কথায় ভুলিয়ে অন্য কোথাও কেউ যদি জাস্ট ছেড়ে দিয়ে আসে ... যেখান থেকে আর কোনোও দিন ফেরা সম্ভব নয় আর সেটাও বেশ কিছুদিন পর জানা গেলে, কেমন লাগবে ভাবুন তো ?





ছবিতে হাতে আর কাঁধে পুটুলি নিয়ে এক নারী-পুরুষের মূর্তি রয়েছে, মাইমা ) আর বাব্বার মূর্তি। সুরিনামের রাজধানী পারেমারিবোতে (শর্টে পার্বোঠিক এই রকম দুটো মূর্তি রয়েছে, তারই রেপ্লিকা হলো কলকাতার এই মূর্তি দুটো। খিদিরপুর ডকের কাছে 'সুরিনাম ঘাট' আছে, সেখানে এই 'মাই -বাব্বার' মানে বাবা আর মায়ের এই পুটুলি নিয়ে মূর্তি দুটো বানানো হয়েছে ২০১৫ তে।


 বেদির ফলকের চারদিকে বাংলা, হিব্দি, ভোজপুরি আর ইংরেজিতে লেখা রয়েছে |




ইতিহাস বেশিরভাগ সময়টাই দুঃখ-কষ্ট-চোখের জল বয়ে নিয়ে যায়। জানতে পারলে কষ্ট বাড়ে বই কমে না ! দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিলের ঠিক মাথার ওপরে ছোট ছোট তিনটে দেশ আছে। গাইয়ানা, সুরিনাম আর ফ্রেঞ্চ গুইজেন। এই সুরিনাম দেশের সাথে ভারতবর্ষ বিশেষ করে কলকাতা, বিহার আর উত্তরপ্রদেশের বহু পুরোনো সম্পর্ক, মোছা দায় ১৮৭৩ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী, ব্রিটিশ জামানা, প্রায় চারশো জন মানুষতাদের মধ্যে পঞ্চাশ জন মহিলা, পঞ্চাশ জন বাচ্চা ) লাল্লা-রুখ নামে এক জাহাজে চড়ে ভিনদেশে পাড়ি দিয়েছিলো কাজের উদ্দেশ্যে, যেখানে তারা ভালো টাকা পাবে আর পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে আসবে তাদের মধ্যে কয়জন ওই ভিনদেশের নাম জানতো বলা মুশকিল ! ৫ই জুন লাল্লা-রুখ সুরিনাম পৌঁছোয়তাই ওই দিন Indian Arrival Day হিসেবে ন্যাশনাল হলিডে পালিত হয় এখন। কিন্তু আসল ব্যাপারটা ছিল একেবারেই অন্য রকম। ওই মানুষগুলো বেচে দেওয়া হয়েছিল ক্রীতদাস হিসেবে। কলকাতা থেকে প্রায় ৬০ খানা জাহাজ গিয়েছিলো ওই সময় সুরিনামে ক্রীতদাস বহন করে। আজ থেকে ১৪৮ বছর আগে ভারত থেকে মোট ত্রিশ হাজার মানুষকে সুরিনামে কাজ করার জন্য দাস বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো লাল্লা-রুখ জাহাজ  ক্রীতদাস বহন করার জন্যই বিখ্যাত। তিনবার সুরিনাম থেকে কলকাতা এসেছে আর মানুষ গুলোকে দাস বানিয়ে নিয়ে গেছে, যারা কোনোদিনও নিজের দেশে আর ফিরতে পারেনি।


'আশনা কানহাই' ভারত-সুরিনামের রাষ্ট্রদূত, যার প্রমাতামহীর বাবা ছিলেন উত্তর প্রদেশের এক গরিব মানুষ। টাকার জন্য সপরিবারে সুরিনাম পাড়ি দিয়েছিলেন। এই সুরিনাম ঘাট থেকেই শেষ বারের মতো গঙ্গা নদীকে দেখেছিল। ভবানীপুরের এক আস্তানায় ভারতের অন্নান্য জায়গা থেকে মানুষ জনকে নিয়ে এসে জাহাজে করে সুরিনাম পাঠানো হতো। ছেলেদের বরাদ্দ ছিল দুটো ধুতি, দুটো কুর্তা  আর মেয়েদের জন্য ছিল দুখানা শাড়ী। সেগুলোই পুটুলিতে থাকতো, সাথে কারোর ছোটোখাটো জিনিস, বিশ্বাসী ঈশ্বরের মূর্তি, ওই কাবুলিওয়ালার মতো প্রিয় মানুষের হাতের ছাপ দেওয়া কাগজ। যখন তাঁরা শেষ বারের মতো নদী পাড়ে এসে জাহাজে উঠেছিলেন, জাহাজ ছাড়ার সংকেত এক ঘন্টার আওয়াজ শুনেছিলেন সেই আওয়াজই নাকি অনেকের ভিটে-মাটি-নদী জড়িত শেষ সম্বল ছিল। ওই যে বোকা বানিয়ে যাদের নিয়ে গেল আর দেখা হয় নি তাঁদের প্রিয়জনদের সাথে কোনোদিনও।


সুরিনামে যাত্রায় পথে অনেকেই মারা যায়। সুরিনাম তখন ছিল ডাচ (নেদারল্যান্ড ) শাসন। সেসময়ে শ্রমিকরূপে দাস বানিয়ে যাদের নিয়ে গিয়েছিলো সেখানে বেশিরভাগ মানুষই ছিল গরিব দেশ গুলোর, আফ্রিকা, ভারত উপমহাদেশের। সুরিনামে ভারতীয় শ্রমিকদের  জীবনযাত্রার হাল খুব খারাপ ছিল কারণ ডাচদের দাস বাণিজ্য প্রথা তখন বিলুপ্তির পথে।  কিন্তু ডাচ মহাজন বা চাষীদের হটাৎ কেন ভারতীয় শ্রমিকের প্রয়োজন কেন ছিল১৮৬৩ সালে নেদারল্যান্ডে (তৎকালীন হল্যান্ডে ) দাসপ্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর সেই সময়ে সুরিনামে ছিল আখের বাগান যা থেকে উৎপন্ন গুড়, চিনি, জাগেরী সারা বিশ্বে সরবরাহ করা হতো, রমরমা বাজার, এককালে যে একচেটিয়া বাজার ছিল আমাদের গৌড়ে। আখ উৎপন্ন এবং বাকি সব কাজের জন্য চাই প্রচুর প্রচুর শ্রমিক। লোক কিভাবে জোগাড় হবে ? ১০ বছর ধরে খোঁজাখুঁজি করে মুনাফা বেশি করার জন্য পাওয়া গেলো ভারতবর্ষের মানুষ গুলোকে। নেদারল্যান্ডে থেকে শ্রমিক নিয়োগের প্রস্তাব এলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে সাথে একটি চুক্তি করে। সেই চুক্তিতে ( Indenture ) লেখা ছিল যে ভারতীয় শ্রমিকরা কোনো বেতন পাবে না, শুধু থাকা-খাওয়া চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে, আর তারা ফিরতে পারবে না নিজের দেশে তাদের টুপি পরিয়ে, লোভ দেখিয়ে বোঝাতে সময় লেগেছিলো তাই কিছু এজেন্টদালাল ) তৈরি করে গ্রামে-গ্রামে ছাড়া হলো। যাদের কাজ ছিল মানুষ ভুলিয়ে বিক্রি করা। উত্তর প্রদেশ এবং বিহার থেকেই বেশিরভাগ মানুষ গুলোকে শ্রমিক রূপে দাস বানিয়ে জাস্ট চালান করে দেওয়া হয়েছিল।  তাঁদের সুরিনামে গিয়ে নতুন নাম হয়েছিল "কুলি" লোক নিয়োগের জন্য আর্কাটিয়া নামে পরিচিত পুরুষদের পাঠানো হয়েছিল। তারা একটি পাঁচ বছরের চুক্তিতে প্রবেশ করে এবং কনট্রাকিস বা এগ্রিমানিস নামে পরিচিত হয়।  ১৯১৭ সালে এই চুক্তিবদ্ধ শ্রম অবশেষে বিলুপ্ত করা হয়েছিল সুরিনাম থেকে।


সুরিনামের পথে ঘাটে ভোজপুরি গানের সাথে সাথে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনা যায়, সমান তালে।





এই যে মূর্তি দুটোর পাশে নদী (হুগলি), এই নদী সে মানুষ গুলোর কাছে কোনো আশার নদী ছিল না, ছিল 'না ফেরার' নদী।


সুরিনাম ঘাটে যেতে হলে 'সিইএসসি'- অনুমতি নিতে হবে, কেননা ঘাটে যাবার রাস্তাটা  'সিইএসসি'- দখলে, কয়লা-ওয়াগন চলে, বিদ্যুৎ তৈরি হয় সেখানে। আমি অনেক সকালে গিয়েছিলাম আর বলেকয়ে ঢুকতে পেরেছিলাম। 

 

Comments

  1. চমৎকার একটি লেখা। ইউনিক। আগে জানতাম না। মনে হয়, অনেকেই জানেন না। খুব ভাল লাগল এই অজানা মানুষদের কথা জেনে। আরও দেবেন। নির্মাল্য কুমার মুখোপাধ্যায়

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

কদম ফুল - Kadam phool- common burflower

বর্ষাকালের সিগনেচার বলা হয় কদম ফুলকে , আরেক নাম নীপ , " এসো নীপ বনে ... " কবিতা তো জানাই আছে যাতে বর্ষা মানেই নীপ ( কদম্ব ও বলে অনেক রাজ্যে ) ।   খুব পরিচিত এই ফুল , নিটোল গোলাকার , প্রথমে সবুজ , পরে লাল থেকে টকটকে কমলা রঙের সাথে অসংখ্য লম্বা সাদা ফ্রিলস পুরো ফুল জুড়ে ।   হাতে নিলে বোঝা যায় বেশ একটু ভারী , মানে কাউকে ঢিল ছুড়ে মারার মতো আর ওই সাদা ফ্রিলস গুলো এমনিতে নরম কিন্তু ছুড়লে হুঁহুঁ , লাগবে বেশ। খুব মিষ্টি একটা গন্ধ আছে , গাছের পাস দিয়ে গেলেই টের পাওয়া যায় ফুল ফুটেছে   ( কদম তলায় কে ?) । প্রচুর ফ্র্যাংগনান্স বা আতর তৈরি হয় এই গন্ধের। আমাদের দেশের লিপিগুলোতে কদম ফুলের ও গাছের নাম আছে আর আমাদের পৌরাণিক কথকথায় কদম ফুলের বড়ো মুখ্য একটা জায়গা আছে।   ভারতের উত্তর দিকে , ভগবৎ পুরান থেকে শুরু রাধা ও কৃষ্ণের দুজনের জীবনেই   কদম ফুল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।   বৃন্দাবন - মথুরায় , গোবর্দ্ধন পাহাড়ের দিকে   প্রচুর কদম গাছ , এই সময় মানে বর্ষাকালে একবার রাধে - রাধে

রাগের ছবি

১ ) মেঘ মল্লার : মেঘ ( সংস্কৃত বুৎপত্তি ) মল্লার একটি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় মৌসুমী   রাগ।   কথায় বলে এই রাগ বৃষ্টিকে আমন্ত্রণ করে যেখানে গাওয়া হয় সেখানে। ' মেঘ মল্লার ' রাগ মেঘের অনুরূপ যার মধ্যে মল্লারের আভা রয়েছে। মল্লার পরিবারের অন্যান্ন রাগগুলি হলো : মেঘ , মিয়াঁ কি মল্লার , গৌড় মল্লার , রামদাসী মল্লার , ধুলিয়া মল্লার ইত্যাদি। ঠাট : কাফি। আমাজন প্রাইমের ' বন্দিশ ব্যান্ডিট ' ওয়েব সিরিজের লাস্ট এপিসোডে ফরিদ হাসান আর মোহাম্মদ আমান মেঘ মল্লার গেয়েছে এবং তাতে বৃষ্টি এসেছে। শঙ্কর - এহসান - লয় এই   গানের দ্বায়ীত্বে ছিলেন। একটা আর্টিকলে তাদের কথা পড়লাম যে , যোধপুরে ২০২০ - র এপ্রিল মাসে এই গানটা যেদিন পুরো গাওয়া হয়েছিল সত্যি বৃষ্টি পড়েছিল , যা কোনোদিনও হয় নি নাকি। ২ ) গৌড় মল্লার :   হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি রাগ যা মল্লারের বৈশিষ্ট্য বহন করে আর এই   ' গৌড় ' নামের রাগটি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে , মানে সে রকম করে কেউ গায় না । মল্লার পরিবারের

My days in the Gunj

এখানে সকাল হয় না, সকাল আসে... কার লেখা, কোন উপন্যাস, অনেকেই জানেন।  গল্পটা এরকম... ডিসেম্বরে হুট্ করে বাইক নিয়ে কোথাও যাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু থাকার জায়গা পেতে চাপ হয়। যেমন এবার হোলো ! ম্যাপ খুঁজে খুঁজে হোমস্টে দেখছি আর ফোন করে যাচ্ছি, ' নাহঃ, ওই সময় ফাঁকা নেই', বেশ কয়েক জায়গা থেকে এক উত্তর পেয়ে ভাবছি কি করবো ! তখনই আমায়রা হোমস্টে-র ওনার রাজ কিশোর গুপ্তা রিং ব্যাক করে 'ম্যাক গার্ডেন-র' হোমস্টে-র কেয়ার টেকার মনজয় দার ফোন নম্বর দিলেন। কল করে জানালাম, পরের দিন যাচ্ছি, একটা ঘরই আমার লাগবে। দু-তিন থাকবো বলাতে বললো, দুদিনই হবে তিন নম্বর দিন অলরেডি বুকড। সাত একর জমির এক কোণে এক কোলোনিয়াল বিল্ডিং, মানে টালির ছাদের কুঁড়েঘর। আম বাগানে ঘেরা, বিরাট এক লন সামনে। গেটের ডানদিকে আলু, সর্ষের খেত। টিয়া, ধূসর রঙের ধনেশ চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে। বাড়ির ভেতরে তিনটে পার্টিশন, প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকেই বসার জায়গা আর দুই প্রান্তে দুটো ঘর। ওই জায়গা পেরিয়ে পেড়িয়ে আবার আর একটা দরজা ও দুই প্রান্তে ডান দিকে-বাঁদিকে দুটো ঘর। মাঝের বসার জায়গায় একটা ফায়ারপ্লেস। শীতকালে গেলে দিব্বি জ্বালিয়ে রাত কাটানো য