Skip to main content

ষাট কবর

ঘটনাটাখুব বেদনাদায়ক, কষ্টের। 

১৬৫৯ সালের ১০ই নভেম্বর কিছুদিন আগে, এক বিশালাকৃতি হোমরা চোমরা আফগান বংশোদ্ভূত সেনাপতি শান্তি চুক্তি করতে যাবে। প্রথমে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর থাকলেও প্রিয় জ্যোতিষীর ভাগ্য গণনা শুনে বেশ মুষড়ে গিয়ে এক গণহত্যার প্ল্যান করেই ফেললো। 

বর্ষার শেষ "নীলল... আকাশে সাদা মেঘের ভেলার" আগমন হয়েছে । বেলা সাড়ে চার, এখনো দিনের আলো আছে। অটোওয়ালাকে বললাম "আমাকে ষাট কবরে নিয়ে চলুন " । অটোওয়ালা গাঁইগুঁই করছিলো বটে, কিন্তু তা বললে তো আর হবে না, সে যতই ঘন ঝোপঝাড় আর জঙ্গল হোক না কেন, যাবো তো বটেই ।  বর্তমানের বিজাপুর (আগে নামছিল বিজয়পুর/বিজয়াপুর, কর্ণাটক ) শহরের বেশ বাইরে নির্জন, ফাঁকা এক সমাধিস্থল । সমাধিস্থলে যাওয়ার জন্য কোন ভালো রাস্তা নেই, ৫০০ মিটারের মতো এবড়ো খেবড়ো রাস্তা হাঁটতে হবে, বর্ষার পরে বলে ঝোপ ঝাড়ে ভর্তি, সাপ হইতে সাবধান।

পুরো দাবার বোর্ডের মতো ৮ * ৮ = ৬৪টা কবর, শুধু কালো পাথরে তৈরি। উঁচু বেদির দিকে মুখ করে দাঁড়ালে বাঁদিকের শেষের কবরটা খোড়া, ওপরের স্ল্যাবটা পাশে পরে আছে। কারোর মতে : কিছু চোর জাতীয় মানুষ গয়না-গাটি, সোনা-দানা খুঁজে পাওয়ার লোভে সেটা ভেঙে ছিল। কারোর মতে কেউ বাঁচার চেষ্টা করেছিল, তবে বেঁচেছিল কিনা বলা দায় !

আফজাল খান ছিল বিজাপুর সালতানাতের আদিল শাহী রাজবংশের একজন সেনাপতি, দ্বিতীয় আদিল শাহের সমকালীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিল। তার ওপর বিজাপুর সালতানাতের রাজত্ব দক্ষিণে সম্প্রসারণ করার দ্বায়িত্ব ছিল। 

আফজাল খান প্রচন্ড শক্তিশালী এবং চরম ধূর্ত ছিল । ছলে ও বলে তার সাথে পেরে ওঠা মুশকিল, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের বড়ো ভাই সাম্ভাজি শাহজী ভোঁসলেকে হত্যা করেছিল। ডেকান অঞ্চলে হাত বাড়াতে হলে শিবাজির মুখোমুখি হতেই হবে আর আফজাল খানের যা স্বভাব ছল-চাতুরী করে শিবাজি মহারাজকে কাছে এনে তার বল প্রয়োগ। সবই সুন্দর পরিকল্পনা মাফিক চলছিল, বাঁধ সাধলো জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎ বাণী : শিবাজির সাক্ষাতে আফজাল খানের মৃত্যু। ছল-চাতুরী করলেও কেন যেন লোকটা জ্যোতিষী শাস্ত্রে বিশ্বাসী ছিল। বিশাল বপু, প্রায় নাকি সাড়ে ৮ ফুটের কাছে উচ্চতা, প্রচন্ড শক্তি। একবার তার সৈন্য দলের আটজন মিলে এক কামান ঠেলে নিয়ে যাবার সময় শুরু মতন গলিতে আটকে যায়, খবর পেয়ে আফজাল খান এক হাতে সেই কামান টেনে বের করেছিল। এই আফজাল খানের *বিবাহিত স্ত্রীর সংখ্যা নেহাত কম ছিল না, ষাটজন । জ্যোতিষীর কথা বিশ্বাস করে আপদ আফজাল খান ভাবলো "আমি তো মরে যাবো শিবাজির হাতে, তো আমার এই ষাটজন বৌয়ের কি হবে ? তারা তো সবাই আবার বিয়ে করবে, নাঃ সেটা তো হতে পারে না । সুতরাং, এদের আমি মরার আগেই মেরে ফেলতে হবে। কোনো কারণে আমি বেঁচে গেলে আবার নাহয় বিয়ে করবো " ।

আফজাল খানের ষাটজন বৌয়ের কবর গুলো 



আবার সেই ছল-চাতুরীর আশ্রয় ! এক-এক করে ষাটজন জলজ্যান্ত মানুষকে কুঁয়োতে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলে তাদের কবর দিয়েছিলো, এই জায়গায় । বিজাপুর ঘুরতে এসে তেমন কেউ আসে না এখানে, কবর স্থানে কী বা থাকে !  তবে কথিত আছে ষাটজন বৌয়ের একজন নাকি বেঁচে গিয়েছিলো তার এক বয়ফ্রেইন্ড-র সাহায্যে তাই ওই একখানা কবরের স্ল্যাবটা খোলা রয়েছে।

 

ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের প্রতাপগড় দুর্গ

ছত্রপতি শিবাজির সাথে শান্তি চুক্তি করতে গিয়ে আফজাল খান ফিরে আসে নি, সত্যি । মহারাষ্টের সাতারা জেলার প্রতাপগড় দুর্গে ওঠার মুখে এক হেয়ারপিন টার্নিংয়ে শিবাজি তার প্রিয় অস্ত্র বাঘনখ দিয়ে আফজাল খানের পেট চিড়ে হত্যা করেছিলন । প্রতাপগড় দুর্গে যাবার সময় জায়গাটা দেখা যায়, ডানদিকে পরে । ঘটনাটা এমন ছিল : আদিল শাহ ও আওরঙ্গজেবের নির্দেশে, আফজাল খান ছত্রপতি শিবাজিকে পরাজিত ও হত্যা করার জন্য তার বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। শিবাজি মহারাজ জানতেন, সমভূমিতে খানকে পরাজিত করা যাবে না, তাই তিনি প্রতাপগড়ে তার দুর্গে চলে যান। এরপরে, শিবাজি খানকে প্রতারণামূলক বিশ্বাস করান যে তিনি সত্যি আত্মসমর্পণ করতে চান এবং মুঘল বাহিনীর সাথে এক জোটে কাজ করতে চান। তাই এক শান্তি চুক্তি হোক। আফজাল খান শামিয়ানা (লাক্সারী তাবু ) খাটিয়েছে প্রতাপগড় দুর্গের ওই হেয়ারপিন টার্নিংয়ে। ছক কষে এক নির্দিষ্ট সময়ে ১৬৫৯ সালের ১০ই নভেম্বরে, যখন শিবাজি বৈঠকের জন্য খানকে তার তাঁবুতে দেখতে যান, তখন তাঁবুতে ঢোকার আগে তাঁকে তার অস্ত্র বাইরে রেখে যেতে হয়েছিল, কিন্তু তার বাঘনখ কেউ বুঝতে পারে নি । আফজাল খান শিবাজিকে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু মহান মারাঠা শাসকের চৌকস কৌশলের কাছে খান হেরে যায় । দাদার হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে মা জিজাবাঈকে আফজাল খানকে হত্যা করা এক উপহার ছিল তাঁর কাছে ।

*অবিবাহিত স্ত্রীর সংখ্যা জানা নেই।


Comments

Popular posts from this blog

কদম ফুল - Kadam phool- common burflower

বর্ষাকালের সিগনেচার বলা হয় কদম ফুলকে , আরেক নাম নীপ , " এসো নীপ বনে ... " কবিতা তো জানাই আছে যাতে বর্ষা মানেই নীপ ( কদম্ব ও বলে অনেক রাজ্যে ) ।   খুব পরিচিত এই ফুল , নিটোল গোলাকার , প্রথমে সবুজ , পরে লাল থেকে টকটকে কমলা রঙের সাথে অসংখ্য লম্বা সাদা ফ্রিলস পুরো ফুল জুড়ে ।   হাতে নিলে বোঝা যায় বেশ একটু ভারী , মানে কাউকে ঢিল ছুড়ে মারার মতো আর ওই সাদা ফ্রিলস গুলো এমনিতে নরম কিন্তু ছুড়লে হুঁহুঁ , লাগবে বেশ। খুব মিষ্টি একটা গন্ধ আছে , গাছের পাস দিয়ে গেলেই টের পাওয়া যায় ফুল ফুটেছে   ( কদম তলায় কে ?) । প্রচুর ফ্র্যাংগনান্স বা আতর তৈরি হয় এই গন্ধের। আমাদের দেশের লিপিগুলোতে কদম ফুলের ও গাছের নাম আছে আর আমাদের পৌরাণিক কথকথায় কদম ফুলের বড়ো মুখ্য একটা জায়গা আছে।   ভারতের উত্তর দিকে , ভগবৎ পুরান থেকে শুরু রাধা ও কৃষ্ণের দুজনের জীবনেই   কদম ফুল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।   বৃন্দাবন - মথুরায় , গোবর্দ্ধন পাহাড়ের দিকে   প্রচুর কদম গাছ , এই সময় মানে বর্ষাকালে একবার রাধে - রাধে

রাগের ছবি

১ ) মেঘ মল্লার : মেঘ ( সংস্কৃত বুৎপত্তি ) মল্লার একটি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় মৌসুমী   রাগ।   কথায় বলে এই রাগ বৃষ্টিকে আমন্ত্রণ করে যেখানে গাওয়া হয় সেখানে। ' মেঘ মল্লার ' রাগ মেঘের অনুরূপ যার মধ্যে মল্লারের আভা রয়েছে। মল্লার পরিবারের অন্যান্ন রাগগুলি হলো : মেঘ , মিয়াঁ কি মল্লার , গৌড় মল্লার , রামদাসী মল্লার , ধুলিয়া মল্লার ইত্যাদি। ঠাট : কাফি। আমাজন প্রাইমের ' বন্দিশ ব্যান্ডিট ' ওয়েব সিরিজের লাস্ট এপিসোডে ফরিদ হাসান আর মোহাম্মদ আমান মেঘ মল্লার গেয়েছে এবং তাতে বৃষ্টি এসেছে। শঙ্কর - এহসান - লয় এই   গানের দ্বায়ীত্বে ছিলেন। একটা আর্টিকলে তাদের কথা পড়লাম যে , যোধপুরে ২০২০ - র এপ্রিল মাসে এই গানটা যেদিন পুরো গাওয়া হয়েছিল সত্যি বৃষ্টি পড়েছিল , যা কোনোদিনও হয় নি নাকি। ২ ) গৌড় মল্লার :   হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি রাগ যা মল্লারের বৈশিষ্ট্য বহন করে আর এই   ' গৌড় ' নামের রাগটি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে , মানে সে রকম করে কেউ গায় না । মল্লার পরিবারের

My days in the Gunj

এখানে সকাল হয় না, সকাল আসে... কার লেখা, কোন উপন্যাস, অনেকেই জানেন।  গল্পটা এরকম... ডিসেম্বরে হুট্ করে বাইক নিয়ে কোথাও যাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু থাকার জায়গা পেতে চাপ হয়। যেমন এবার হোলো ! ম্যাপ খুঁজে খুঁজে হোমস্টে দেখছি আর ফোন করে যাচ্ছি, ' নাহঃ, ওই সময় ফাঁকা নেই', বেশ কয়েক জায়গা থেকে এক উত্তর পেয়ে ভাবছি কি করবো ! তখনই আমায়রা হোমস্টে-র ওনার রাজ কিশোর গুপ্তা রিং ব্যাক করে 'ম্যাক গার্ডেন-র' হোমস্টে-র কেয়ার টেকার মনজয় দার ফোন নম্বর দিলেন। কল করে জানালাম, পরের দিন যাচ্ছি, একটা ঘরই আমার লাগবে। দু-তিন থাকবো বলাতে বললো, দুদিনই হবে তিন নম্বর দিন অলরেডি বুকড। সাত একর জমির এক কোণে এক কোলোনিয়াল বিল্ডিং, মানে টালির ছাদের কুঁড়েঘর। আম বাগানে ঘেরা, বিরাট এক লন সামনে। গেটের ডানদিকে আলু, সর্ষের খেত। টিয়া, ধূসর রঙের ধনেশ চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে। বাড়ির ভেতরে তিনটে পার্টিশন, প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকেই বসার জায়গা আর দুই প্রান্তে দুটো ঘর। ওই জায়গা পেরিয়ে পেড়িয়ে আবার আর একটা দরজা ও দুই প্রান্তে ডান দিকে-বাঁদিকে দুটো ঘর। মাঝের বসার জায়গায় একটা ফায়ারপ্লেস। শীতকালে গেলে দিব্বি জ্বালিয়ে রাত কাটানো য